অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আইসিএল শফিক। প্রতারনা করে অর্থ আত্মসাৎ, গ্রাহকের মামলা থেকে রক্ষা, প্রভাব বিস্তার ও নানা অপকর্ম থেকে বাঁচতে আওয়ামীলীগের সাবেক এক মন্ত্রীর ছত্রছায়ায় থাকলেও আওয়ামীলীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এবার বিএনপি ও জামাতের রাজনীতিতে যুক্ত হতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। প্রস্তাব দিচ্ছেন মোটা অংকের অনুদান দেওয়ার। এর আগে তিনি জামায়াত থেকে জাতীয় পাটির রাজনীতি করেছেন। পরে ছত্রছায়ায় ছিলেন সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও চৌদ্দগ্রামের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক মুজিব এর আশ্রয়ে।
গ্রাহকের টাকা আত্নসাৎ, জমি দখল অপহরনসহ বিভিন্ন অপকর্মের কারনে তাঁর বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে হয়েছিলো শতাধিক মামলা। স্ত্রীসহ তিনি জেল খেটেজেল একাধিকবার। গ্রাহকরা মামলা দেওয়ায় তাদের অপহরন, সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে মারধর, ভয়ভীতি প্রদর্শন, জোর পূর্বক তাদের কাছ থেকে খালি ষ্টাম্পে স্বাক্ষর আদায়সহ মামলা তুলে নিতে নানা হয়রানি করেছেন। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন সাবেক রেলমন্ত্রীর প্রভাব ও অর্থের বিনিময়ে নিজের অনুকূলে এনেছেন আবার অনেক প্রতিবেদন স্থগিত রেখেছেন। শফিক তার এসকল অপকর্ম ঢাকতে ও প্রভাব বিস্তার করতে সব সময় ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় আশ্রয় নেন। টাকার বিনিময়ে ম্যানেজ করে দল পরিবর্তন করেছেন একাধিকবার বার।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, আইসিএল শফিক শুরুতে জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন এবং ইসলামী ব্যাংকে চাকুরি করতেন। ব্যাংকের অর্থ কেলেংকারী কারনে চাকুরী হারান। এ বিষয়ে মামলা করেন ইসলামী ব্যাংক। পরে শফিক তার পৈত্রিক ভিটাসহ সকল সম্পত্তি বিক্রি করে ইসলামী ব্যাংকের অর্থ পরিশোধ করে মামলা থেকে রেহায় পান। হয়ে পড়েন একবারে নিঃস্ব ও অসহায়। অন্যদিকে কুমিল্লা নগরীর বজ্রপুর এলাকায় নারী ঘটিত কলেংকারীতে জামায়াত তাকে দল থেকে বহিষ্কার করেন।
ব্যাংকে চাকুরী করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার ৫নং শুভপুর ইউনিয়নের ধনিজকরা এলাকার বাসিন্দা সোবেদ আলীর ছেলে শফিকুর রহমান গড়ে তুলেন সমবায়ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আইডিয়েল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড (আইসিএল)। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতারনা করে বনে যান জিরো থেকে হিরো।
গ্রাহকরা জানান, আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি ২০০১ সাল থেকে দ্বিগুণ মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে হজ্ব আমানত, ডিপিএস, মাসিক মুনাফা, দ্বিগুণ বৃদ্ধি আমানত, শিক্ষা আমানত, আবাসন আমানত, ব্যবসায়িক আমানত, দেনমোহর আমানত, কোটিপতি ডিপোজিট স্কিম, লাখপতি ডিপোজিট স্কিম প্রকল্পের নামে অর্থ সংগ্রহ করে। কেউ জমি বিক্রি করে, কেউবা তিলে তিলে জমানো সব সঞ্চয় জমা দিয়েছেন। ব্যাংক থেকে চলতি ফিক্সড ডিপোজিট ভাঙিয়েও জমা দিয়েছেন আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে (আইসিএল)। অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে তিন হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে আইসিএল। সর্বস্ব হারিয়ে দিশেহারা পরিবারগুলোর কান্নাই শেষ সম্বলে পরিণত হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকে মাত্র তিন বছরে রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টনের প্রধান অফিসসহ কুমিল্লা ও দেশের অন্যান্য জায়গার ৩৬টি শাখা অফিসের মাধ্যমে কয়েক লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে। তারমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের একটি বড় অংশ কুমিল্লার।
আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটির গ্রাহকদের সকল টাকা বিনিয়োগ করেন আইসিএল রিয়েল এষ্টেট এন্ড ডেভেলপারস লিমিটেড নামে তার আরেকটি প্রতিষ্ঠানে। যার এমডি শফিক নিজে, পরিচালক রাখা হয় তার স্ত্রী শামসুন নাহার মীনা, ছেলে শহিদুল হক, মেয়ে শিরিন শবনম, শ্যালক কাজী ফখরুল ইসলামকে। আইসিএল বন্ধ হওয়ার পর আইসিএল রিয়েল এষ্টেট এন্ড ডেভেলপারস এর সকল জমি বিক্রি করে শত শত কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে শফিক। শফিকের মেয়ে তামান্না ও ছেলে শহিদুল হক রয়েছেন লন্ডনে, আরেক মেয়ে শিরিন শবনম আছেন আমেরিকায়। ছোট মেয়ে রয়েছেন কানাডায়। শফিক গ্রাহকদের শত শত কোটি টাকা পাচার করেন ছেলে মেয়েদের কাছে। শফিকের স্ত্রী সন্তানসহ সকলের রয়েছে আমেরিকার পাসপোর্ট। যার ফলে সবসময় বিদেশে আসা যাওয়া তাদের পরিবারের সদস্যদের। শফিক বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতার আশ্রয়ে ঢাকায় বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে ও দামী গাড়ী চড়ে বেড়ান। বিদেশে তার ছেলে ও মেয়েদের রয়েছে ফ্ল্যাট ও দামী গাড়ী। শফিক ও তার পরিবারের সদস্যদের কোন ব্যবসা বানিজ্য না থাকলেও গ্রাহকদের টাকায় কেনা জমি বিক্রি করে সকলেই দেশে ও বিদেশে রাজকীয় জীবন যাপন করছেন।
২০১৩ সালের মার্চ মাসে আইসিএল বন্ধ হওয়ার পর কুমিল্লার বিনিয়োগকারীরা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমান ও অন্যান্যের বিরুদ্ধে প্রতারণা, চেক জালিয়াতি এবং অর্থ আত্মসাতের মামলা করে। প্রায় ৫ মাস বিদেশে আত্মগোপনে থাকার পর ওই বছরের ২২ আগষ্ট কুমিল্লায় গ্রেফতার হোন আইসিএল প্রধান শফিকুর রহমান। বেশকিছুদিন পর জামিনে বের হোন শফিক। এরিমধ্যে শফিক ও তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন গ্রাহকের দায়ের করা চেক প্রতারণাসহ অন্যান্য মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে। এদিকে গ্রাহকের দায়ের করা মামলায় কয়েকবার জেল খেটেছেন আইসিএল প্রধান শফিকুর রহমান ও তার স্ত্রী শামসুন নাহার মীনা।
জানা যায়, জালিয়াতির মাধ্যমে প্রতারণার কারণে আইসিএল গ্রুপের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়া সমবায় মন্ত্রনালয় থেকে একটি তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। অর্থ ও ক্ষমতার অপব্যবহারে এসব তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি।
অপরদিকে ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিভাগীয় সমবায় কার্যালয়ের যুগ্ম নিবন্ধক কতৃক তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয় “আইডিয়াল কো-অপারেটিভ সোসাইটি লি. এর ব্যবস্থাপনা কমিটির কর্মকর্তাবৃন্দ এবং এর অপরাপর কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্তৃক ১৮০ কোটি ৮৬ লাখ ৯২ হাজার ৬৮৭ টাকা তছরূপ ও আত্মসাৎ করা হয়।
ঢাকা কর্তৃক সমবায় কমিটি আইন ২০০১ এর ৮৩(১) (২) ধারা মতে চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এতে গ্রাহকদের টাকা আত্মসাৎ এর মাষ্টারমাইন্ড হিসেবে উল্লেখ করা হয় শফিকুর রহমানকে। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন শফিক সাবেক রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হকসহ তৎকালীন আওয়ামী ক্ষমতাশীনদের প্রভাবে ও অর্থের বিনিময়ে ডিপফ্রিজে বন্ধী করে রাখেন।
সমবায়ের তদন্ত করার পর অনেক জমি ছিলো আইসিএলএর। তখন শফিক এসব জমি বিভিন্ন প্রতারনার মাধ্যমে জমি বিক্রির শতকরা ২০ ভাগ মূল্য দেখিয়ে বাকি ৮০ শতাংশ টাকা আত্মসাৎ করে। অনেক জমি নিজের ছেলে মেয়েসহ স্বজন ও ঘনিষ্ট লোকদের কাছে নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করে পরে অন্যদের কাছে বেশি দামে বিক্রয় করেন। এছাড়া বিভিন্ন নামে বেনামে গ্রাহকদের ভূয়া রিসিট তৈরী করে জমি বিক্রির টাকা গ্রাহকদের সাথে সমন্বয় করেছেন বলে সমবায় তদন্ত কমিটিকে জানায়। আড়াল করা হয় প্রকৃত গ্রাহকদের।
অসহায় গ্রাহকদের দাবী নতুন বাংলাদেশে সহসাই পূনরায় এ তদন্ত প্রতিবেদন আবার যেন শুরু হয় এবং গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করতে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে গ্রাহকদের টাকা আত্নসাৎ করে বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে আইসিএল শফিক। জমি দখল অপহরনসহ নানা অপকর্ম করে বেড়াচ্ছে শফিক। তার এ অপকর্ম করতে ও জনরোষ থেকে বাঁচতে সব সময় বেঁচে নিয়েছেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের আশ্রয় ও নেতাদের আর্শিবাদ। শুরুতে জামায়াতের রাজনীতির সাথে জড়িত থাকলেও দল থেকে বহিষ্কার হন। পরে আওয়ামীলীগ ও জাতীয় পাটি ক্ষমতায় আসলে তিনি যোগ দেন জাতীয় পাটিতে। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে কিছু নেতাদের ম্যানেজ করে জাতীয় পাটির (এরশাদ-জিএম কাদের) কেন্দ্রিয় সাংগঠনিক সম্পাদক পদ নেন। এদিকে জাতীয় পাটির তৃনমুলের নেতাকর্মীরা তার অপকর্মে মাঠ পর্যায়ে বিব্রত অবস্থায় পড়েন। পরে নেতৃমুল নেতাদের দাবীর মুখে তাকে জাতীয় পাটি থেকে বাদ দেওয়া হয়। এরপর তিনি মোটা অংকের টাকা দিয়ে রওশন এরশাদ এর জাপা অংশের প্রেসিডিয়াম সদস্য হন। সেখানে বেশি সুবিদা করতে না পেরে পরে তিনি আশ্রয় নেন চৌদ্দগ্রাম থেকে নির্বাচিত আওয়ামীগের সাবেক সংসদ সদস্য ও রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক মুজিবের। তাঁর ছত্রছায়ায় তিনি নিজেকে নিরাপদ রাখেন ও বিভিন্ন অপকর্ম করে বেড়ায়। সম্প্রতি দেশের পটভূমি পরিবর্তনের ফলে তিনি প্রথমে জামায়াতে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তাকে নেওয়া হয়নি পরে বিএনপিতে গিয়েও সুবিদা করতে পারেননি বলে একটি সূত্র জানায়। তিনি বিএনপি বা জামায়াতের রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে তার অপকর্ম ঢাকতে চাচ্ছেন। সেজন্য এ দু দলেরই উচ্চ মহলের সাথে তদবির করছেন বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা বিএনপির সভাপতি মোঃ কামরুল হুদা জানান, শফিক এর বিরুদ্ধে বিভিন্ন গ্রাহকের টাকা আত্নসাৎসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে। এমন লোক দলে এনে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবো কেন। তাঁর অপকর্মের ভার বিএনপি নেবে কেন। বিএনপিতে যোগদানের বিষয়ে আমাদের সাথে তাঁর কোন কথা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে চৌদ্দগ্রাম উপজেলা জামায়াতের আমীর মোঃ মাহফুজুর রহমান জানান, শফিকুর রহমান জাতীয় পাটির একজন কেন্দ্রিয় নেতা। জামায়াতের কেন্দ্রিয় নির্দেশনা রয়েছে আপাতত দলে সকল যোগদান বন্ধ। এছাড়া শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মানুষের টাকা আত্নসাৎ সহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে। আমরা এ ধরনের লোকদের দলে নেওয়ার প্রশ্ন উঠেনা।
এ বিষয়ে আইসিএলর ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিকুর রহমানের সাথে বিভিন্ন মাধ্যমে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
ছবিঃ ১/ সাবেক রেলপথ মন্ত্রী ও চৌদ্দগ্রামের সংসদ সদস্য মুজিবুল হক মুজিব এর বাসভবনে শফিকুর রহমান, অপরদিকে জাপা নেতা রওশন এরশাদের কর্মসূচিতে রওশনপন্থী জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুর রহমান।